জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে বড় ধরনের পরিমার্জন করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণের জন্য প্রস্তুত বইগুলো থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে ব্যবহৃত ‘জাতির পিতা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’সহ একাধিক বিতর্কিত বিষয় বাদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পাঠ্যবইয়ে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জুলাই বিপ্লব, বাকশাল ব্যবস্থা, শেখ হাসিনার শাসনকাল ও তার পলায়নের ঘটনা।
এ ছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন, এরশাদের নয় বছরের স্বৈরশাসন এবং পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়ার শাসনামলের ইতিহাসও পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রকাশিত ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক স্তরের ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবই পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির জন্য ছাপানো বইটির ২১ পৃষ্ঠায় ৭ মার্চের ভাষণের বর্ণনায় পাঁচ জায়গায় শুধু ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ লেখা হয়েছে। আগের শিক্ষাবর্ষে একই স্থানে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ লেখা ছিল। তবে বইয়ের বিভিন্ন অংশে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও দেখা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম শিরোনামের তৃতীয় অধ্যায়ের পাঠ-২-এ ৭ মার্চের ভাষণের বর্ণনায় সাত জায়গার মধ্যে ছয় জায়গায় ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের কাজ-৩ অংশে এখনো ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি রয়ে গেছে। এটি ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত—সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির একটি সূত্র জানায়, উপাধি হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু’ ব্যবহৃত হলে তা সংশোধন করা হয়নি। তবে নামের ক্ষেত্রে ‘বঙ্গবন্ধু’ বাদ দিয়ে ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ লেখা হয়েছে।
সূত্রটি আরও জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর পাঠ্যবইয়ে ব্যাপক পরিমার্জন আনা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে লিখিত নির্দেশনা পাওয়ার পর মাধ্যমিক স্তরের বইয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে ব্যবহৃত ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেয় এনসিটিবি।
এনসিটিবির পাঠ্যবই সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত এক বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং পৌরনীতি বইয়ে দেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবইয়েও পরিবর্তন আনা হয়েছে। বইগুলো ইতোমধ্যে প্রকাশিত হলেও শুরুতে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছিল না। রোববার নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত জনসভায় তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়।
গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে নিয়মিতভাবে ‘জাতির পিতা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ব্যবহৃত হতো, যার প্রতিফলন পাঠ্যবইয়েও দেখা গেছে।
তবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির ব্যবহার নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। ২০০১ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ড. মুহাম্মদ ইয়াহিয়া রহমানের তত্ত্বাবধানে করা এক পিএইচডি গবেষণায় দাবি করা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের বহু আগেই মুন্সী মেহেরুল্লাহ এই উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। গবেষণাটি করেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর সরকারি মহসীন কলেজের শিক্ষক ড. মো. জহুরুল ইসলাম।
এ বিষয়ে লেখক মতিউর রহমান মল্লিকও উল্লেখ করেছেন যে, মির্জা ইউসুফ আলী প্রথম মুন্সী মেহেরুল্লাহকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন। ঢাকাভিত্তিক ‘প্রেক্ষণ সাহিত্য সংগঠন’ ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ স্মরণ সংখ্যা’ গ্রন্থেও এ তথ্য উঠে আসে।
মুন্সী মেহেরুল্লাহ ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক ও ধর্মপ্রচারক। তিনি ১৮৬১ সালের ২৬ ডিসেম্বর যশোর জেলার তৎকালীন কালীগঞ্জ থানার ঘোপ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯০৭ সালের ৮ জুন ৪৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র: আমার দেশ
আলোকিত গৌড়/এম.আর
মন্তব্য করুন: