[email protected] মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫
২৯ আশ্বিন ১৪৩২

চাকরি নেই, প্রেমও টেকে না: বেকার তরুণদের জীবনের নির্মম বাস্তবতা

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩২

ফাইল ছবি

‘জানো মা, হিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, পাত্র স্কুলমাস্টার। পাগলি মেয়েটা বলতে পারেনি বেকার ছেলেটাকে ভালোবাসে।’ —বিশ্বজিৎ হালদারের কবিতার এই কয়েকটি লাইন যেন আজকের প্রজন্মের তরুণদের বাস্তব চিত্র।

রাত ১০টা। শহরের এক ছোট্ট কফিশপের কোণে বসে আছে আয়ান ও নীলা (ছদ্মনাম)। কফির কাপের পাশে জমে উঠেছে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়।
নীলা চেঁচিয়ে বলল, ‘তুমি শুধু বলো, এভাবে আর কতদিন চলবে? আমার মা–বাবা পাত্র ঠিক করেছেন। চাকরি করে, ভালো বেতন।’
চোখে ক্লান্তি নিয়ে আয়ান শুধু বলল, ‘আমি চেষ্টা করছি নীলা, কিন্তু চাকরি পাচ্ছি না।’

তিন বছরের প্রেম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেট ক্লাবে পরিচয়, হাত ধরাধরি করে কফি খাওয়া, একসঙ্গে ভবিষ্যতের স্বপ্ন—সবই ছিল রূপকথার মতো। কিন্তু গল্প থেমে যায়, যখন একটার পর একটা ইন্টারভিউ শেষে আয়ান ফিরে আসে খালি হাতে।

এ গল্প শুধু আয়ান–নীলার নয়; এটা বাংলাদেশের হাজারো তরুণ–তরুণীর গল্প। চাকরি নেই, প্রেম ভেঙে যাচ্ছে—এটাই এই পোস্টমডার্ন সমাজের তরুণ জীবনের নির্মম বাস্তবতা।

চাকরির বিজ্ঞপ্তিও এখন ভয়

চাকরির বিজ্ঞপ্তি এখন আর কেবল আহ্বান নয়, তা অনেক তরুণের কাছে আতঙ্কও। কারণ, প্রতিযোগিতা, ব্যয় আর অনিশ্চয়তা তাঁদের সম্পর্কেও চাপ ফেলছে।

গত জুলাইয়ের ছাত্র–জনতার আন্দোলনের (২০২৪) অন্যতম দাবি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিল। উচ্চ আদালতের রায়ে তা হয়েছে, কিন্তু মেধাবী তরুণদের সুযোগ কতটা বেড়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।

অন্যদিকে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিও এখনো অপূর্ণ। বিশ্বের বহু দেশে যেখানে ৪০ বছর বয়সেও সুযোগ থাকে, সেখানে বাংলাদেশে বয়স যেন অদৃশ্য এক প্রাচীর।

শিক্ষিতরাই বেকারতার শিকার

দেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যেই বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি। শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত বেকারের হার সর্বোচ্চ।
প্রতি পাঁচজন বেকারের একজনই স্নাতক বা উচ্চমাধ্যমিক সনদধারী।
অন্যদিকে, যাঁদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাঁদের বেকারত্ব সবচেয়ে কম—মাত্র ১.২৫ শতাংশ।
অর্থাৎ, মাঠে–ঘাটে যারা কাজ করছেন, তারাই অন্তত বেকারত্বের তালিকা থেকে নিজেদের নাম কাটাতে পেরেছেন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদণ্ড অনুযায়ী, সপ্তাহে এক ঘণ্টা মজুরি পেলেই কেউ ‘বেকার’ নন। সেই হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ২৪ হাজার।
কিন্তু বাস্তবে সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে কেউ টিকে থাকতে পারেন না। প্রায় এক কোটি মানুষ ‘ছদ্মবেকার’।

বেকারত্ব ভাঙছে সম্পর্ক

বাংলাদেশের সমাজে প্রেম এখনো পরিবারের অনুমোদনের সীমায় বন্দী।
একজন তরুণের মূল্য নির্ধারিত হয় তাঁর চাকরি, বেতন বা ফ্ল্যাটের আয়তনের ওপর। চাকরি না থাকলে প্রেমিকা বা তাঁর পরিবারের কাছে তাঁর কোনো মূল্য থাকে না।
‘ছেলে চাকরি করে না’—এই এক বাক্যেই সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে।

বেকারত্বের কারণে সম্পর্ক ভাঙার হার ৩০ শতাংশ বেশি—বিভিন্ন গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনের এক কাপ চা–এর প্রেম এখন টাকার ওপর দাঁড়ানো বাস্তবতায় বদলে গেছে।

সমাজ–রাষ্ট্রের করণীয়

বেকারত্বের ফাঁদ থেকে বেরোতে হলে সমাজের মনোভাব বদলাতে হবে। চাকরি না থাকলেই কেউ ‘অযোগ্য’—এই ধারণা ভাঙা জরুরি।

তরুণ–তরুণীরা একসঙ্গে লড়াই করতে পারেন, ফ্রিল্যান্সিং, স্কিল ডেভেলপমেন্ট বা ছোট উদ্যোগে নিজেদের যুক্ত করতে পারেন।

পরিবারগুলোকেও মানসিকভাবে সহযোগিতামূলক হতে হবে।
প্রেম বা বিবাহের মানদণ্ড হিসেবে চাকরি নয়, যোগ্যতা ও চরিত্রকে গুরুত্ব দিতে হবে।

সরকারেরও ভূমিকা অপরিহার্য—নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও তরুণদের জন্য বেকার ভাতা চালুর মাধ্যমে চাপ কমানো যেতে পারে।

শেষকথা

প্রেম টিকিয়ে রাখতে চাই সহানুভূতি, বোঝাপড়া এবং এমন এক সমাজ যেখানে ‘চাকরি নেই’ মানেই ‘ভালোবাসা নেই’ নয়।
তরুণ প্রাণে ফিরে আসুক আশাবাদ ও সৃজনশীলতার আলো।

আলোকিত গৌড়/আ

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর