সবুজ পাতার নিঃশ্বাসে যে প্রাণ, বাতাসে যে জীবন, জলধারার কলতানে যে সুর—তার সবই মহান আল্লাহর এক অনুপম দান। মানুষ যখন এই দানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, তখন সে উপলব্ধি করে—প্রকৃতি শুধু বেঁচে থাকার অবলম্বন নয়, বরং সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যের এক নিঃশব্দ উপাসনালয়। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার আগ্রাসনে সেই উপাসনালয় আজ আগুনে জ্বলছে—বন উজাড় হচ্ছে, নদী মরছে, বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ।
ফলে মানুষ নিজেই নিজের অস্তিত্ব ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ ইসলাম শেখায়, প্রকৃতির যত্ন নেওয়া শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং ইবাদতেরই অংশ।
আল-কোরআনে সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষার নির্দেশ
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন—
“আর তিনি পৃথিবীকে জীবজগতের জন্য স্থাপন করেছেন।”
— সুরা আর-রহমান, আয়াত : ১০
এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয়, পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য নয়; এটি সকল প্রাণীর সম্মিলিত আবাসস্থল। তাই মানুষ যদি অকারণে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তবে সে আল্লাহর নির্ধারিত ভারসাম্য নষ্ট করছে।
আরেক আয়াতে বলা হয়েছে—
“পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর তাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না।”
— সুরা আল-আরাফ, আয়াত : ৫৬
প্রখ্যাত তাফসিরবিদ ইমাম ফখরুদ্দীন আর-রাজি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন—
“যে বৃক্ষ ধ্বংস করে, নদী দূষিত করে বা প্রাণীদের প্রতি অন্যায় করে, সেও পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী (মুফসিদ)।”
পরিবেশবান্ধব হতে নবীজির শিক্ষা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“যদি কিয়ামত সংঘটিত হতে থাকে, আর তোমার হাতে কোনো খেজুরগাছের চারা থাকে, তবে সেটি রোপণ করে ফেলো।”
— (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১২৯০২)
এই হাদিস প্রমাণ করে যে, ইসলাম জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টির সেবায় থাকতে আহ্বান জানায়।
আরেক হাদিসে নবীজী (সা.) বলেন—
“যে ব্যক্তি একটি গাছ রোপণ করে, এবং তাতে মানুষ বা প্রাণী আহার করে, তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।”
— (বুখারি, হাদিস : ২৩২০)
অর্থাৎ বৃক্ষরোপণ কেবল পরিবেশ সংরক্ষণ নয়, বরং চলমান সওয়াবের একটি ইবাদত।
তিনি আরও বলেছেন—
“অন্যায়ভাবে কোনো জীব হত্যা করো না।”
— (মুসলিম, হাদিস : ১৯৫৫)
বন্যপ্রাণী রক্ষা ও প্রাণীর প্রতি সহমর্মিতা তাই ইসলামী নৈতিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মুসলিম স্কলারদের দৃষ্টিতে পরিবেশ
ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) লিখেছেন—
“আল্লাহর সৃষ্ট জগতের প্রতিটি কণায় তাঁর প্রশংসা প্রতিফলিত হয়; যে প্রকৃতিকে অবহেলা করে, সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নিদর্শনকে অবমাননা করে।”
— (মিফতাহু দারিস সাআদাহ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৮৮–৮৯)
ইমাম গাজালী (রহ.) বলেন—
“মানুষ পৃথিবীর আমানতদার; সে যদি এই আমানতের অপচয় করে, তবে কিয়ামতের দিন তাকে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।”
— (ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২৩৮–২৩৯)
অর্থাৎ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা ও সম্পদের সঠিক ব্যবহারই এই “আমানত”-এর দাবি।
ইবাদতের বিস্তৃত দিগন্ত
ইবাদত শুধু নামাজ, রোজা বা হজে সীমাবদ্ধ নয়। ইসলাম মানবসেবা, প্রকৃতির যত্ন, পানি সংরক্ষণ—সবকিছুকেই ইবাদতের অংশ হিসেবে গণ্য করেছে।
আল্লাহ বলেন—
“আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদতের জন্য।”
— (সুরা আজ-জারিয়াত, আয়াত : ৫৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“পানি ব্যবহারে অপচয় করো না, যদিও তুমি প্রবহমান নদীর ধারে থাকো।”
— (ইবন মাজাহ, হাদিস : ৪২৫)
এ হাদিস পরিবেশ-সচেতনতার এমন এক নৈতিক মানদণ্ড শিখিয়েছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকার করে।
আমরা যদি সত্যিকারের আল্লাহভীরু হই, তবে বৃক্ষরোপণ, দূষণ প্রতিরোধ, পানি ও বাতাসের সংরক্ষণ—সবকিছুই আমাদের নিত্য ইবাদতের অংশ হয়ে উঠবে।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সৃষ্টির নিপুণ সৌন্দর্য রক্ষা করে তাঁর সন্তুষ্টির পথে অগ্রসর হওয়ার তাওফিক দিন।
আলোকিত গৌড়/আ
মন্তব্য করুন: