ইসলামী জীবনব্যবস্থায় মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য, সহানুভূতি ও পারস্পরিক সম্মান সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের শিষ্টাচার মানুষের হৃদয়ে সৌন্দর্য ও স্নেহের বন্ধন সৃষ্টি করে। এরই ধারাবাহিকতায় অতিথি বা মেহমানের সম্মান প্রদর্শন ইসলামী সভ্যতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।” (বুখারি, হাদিস: ৬০১৮; মুসলিম, হাদিস: ৪৭)।
এই সংক্ষিপ্ত বাণী ইসলামী আদর্শের গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। এতে বোঝা যায়, ঈমান কেবল অন্তরের বিষয় নয়; বরং তা আচরণেও প্রতিফলিত হয়।
অতিথি সম্মান করা মানে শুধু খাওয়ানো বা থাকার ব্যবস্থা নয়; বরং আন্তরিক অভ্যর্থনা জানানো, সম্মানজনক ব্যবহার করা এবং তার আরাম-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে খেয়াল রাখা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা নবী ইব্রাহিম (আ.)-এর অতিথি আপ্যায়নের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—
“তুমি কি ইব্রাহিমের সম্মানিত অতিথিদের খবর পেয়েছ?” (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ২৪)।
এই আয়াতে ‘সম্মানিত অতিথি’ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, অতিথি যেমন সম্মানের দাবিদার, তেমনি তার সঙ্গে আচরণও হতে হবে মর্যাদাপূর্ণ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও অতিথি আপ্যায়নের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি কখনো অতিথিকে নিজের আগে আহার করাতেন, কখনো নিজের চাদর বিছিয়ে দিতেন। সাহাবায়ে কেরামও তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের অল্প আহার অতিথির সঙ্গে ভাগ করে নিতেন। এমনকি অনেক সময় তাঁরা সন্তানদের খাবার বঞ্চিত করে অতিথিকে অগ্রাধিকার দিতেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে অতিথি আপ্যায়ন কেবল সামাজিক সৌজন্য নয়, এটি ঈমানেরই অংশ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
“অতিথি তিন দিন সম্মান পাওয়ার অধিকারী; একদিন পূর্ণ আপ্যায়ন, পরবর্তী দুই দিন কিছুটা হালকা। এরপর অতিরিক্ত কিছু করলে তা সদকা।” (বুখারি, হাদিস: ৬০১৯)।
অর্থাৎ ইসলাম একদিকে অতিথি-সেবা উত্সাহিত করেছে, অন্যদিকে বাস্তবতার ভারসাম্যও বজায় রেখেছে।
আজকের যান্ত্রিক ও স্বার্থনির্ভর সমাজে মানুষের সম্পর্ক যখন শীতল হয়ে পড়ছে, তখন ইসলামের এই অতিথি-সম্মানের শিক্ষা সমাজে উষ্ণতা ও ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে পারে। অতিথি আপ্যায়ন মানুষকে বিনয়, ত্যাগ ও সহানুভূতির অনুশীলন করায়—যা ইসলামী চরিত্র গঠনের অপরিহার্য অংশ।
অতএব, অতিথি আপ্যায়ন কেবল একটি সামাজিক রীতি নয়; এটি ঈমানের বাস্তব প্রতিফলন। যে হৃদয়ে আল্লাহ ও আখিরাতের ভয় রয়েছে, সে জানে—প্রত্যেক অতিথি আসলে এক বরকত, এক পরীক্ষা ও এক সুযোগ; যার মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের আনন্দ।
ইসলামের এই মনোমুগ্ধকর নীতি সমাজকে করে তোলে ভালোবাসা, আতিথেয়তা ও মানবতার আলোকিত আবাস।
আলোকিত গৌড়/আ
মন্তব্য করুন: