মানুষের জীবন তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত—দুনিয়ার জীবন, বারজাখের জীবন ও পরকালের অনন্ত জীবন। দুনিয়ার জীবন হলো পরীক্ষার স্থান, পরকাল হলো ফলাফলের ক্ষেত্র। আর বারজাখ হলো এই দুইয়ের মধ্যবর্তী এক রহস্যময় জগৎ, যেখানে মৃত্যুর পর আত্মা অবস্থান করে কিয়ামত পর্যন্ত।
‘বারজাখ’ শব্দটি এসেছে আরবি থেকে, যার অর্থ প্রাচীর, বাধা বা বিভাজন। এটি দুটি জগতের মাঝে এমন এক সীমারেখা, যা একে অপরকে অতিক্রম করতে দেয় না। কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“তিনি দুটি সমুদ্রকে প্রবাহিত করেছেন, তারা মিলিত হয়; তবু তাদের মধ্যে রয়েছে এক প্রতিবন্ধক, যাতে তারা সীমা অতিক্রম করতে না পারে।”
(সুরা আর-রাহমান, আয়াত ১৯–২০)
এই আয়াত থেকেই বোঝা যায়, বারজাখ হলো এক অদৃশ্য পর্দা—যা দুনিয়া ও পরকালের মাঝে বিদ্যমান। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের আত্মা এই বারজাখে প্রবেশ করে এবং কিয়ামত না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে।
মৃত্যুর পর ফেরেশতারা মানুষের আত্মা গ্রহণ করেন, এবং শুরু হয় আত্মার নতুন যাত্রা। এই যাত্রার প্রথম স্তর হলো কবরের জীবন। ফেরেশতা মুনকার ও নাকীর এসে মৃত ব্যক্তিকে প্রশ্ন করেন—“তোমার প্রভু কে? তোমার দ্বীন কী? আর তোমার নবী কে?”
যদি মৃত ব্যক্তি ঈমানদার হয়, সে সহজেই উত্তর দেয়, তার কবর জান্নাতের বাগানে পরিণত হয় এবং সে প্রশান্তি অনুভব করে। কিন্তু অবিশ্বাসী ও পাপাচারীর কবর সংকুচিত হয়ে যায়, আগুনের শাস্তি পেতে থাকে এবং জাহান্নামের দৃশ্য দেখতে পায়।
বারজাখের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো—আত্মা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও এক প্রকার সম্পর্ক বজায় রাখে। আত্মা কখনো কখনো দেহে ফিরে আসে—বিশেষত ফেরেশতাদের প্রশ্নের সময় বা কবর জিয়ারতের মুহূর্তে। এমনকি মৃত আত্মা তার প্রিয়জনদের কণ্ঠ শুনতে পায় এবং তাদের দোয়া ও ইসালে সওয়াব তার কাছে পৌঁছে যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ মারা যায়, তখন সকাল ও সন্ধ্যায় তাকে তার জান্নাত বা জাহান্নামের স্থান দেখানো হয়। যদি সে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে তাকে জান্নাতে তার স্থান দেখানো হয়; আর যদি সে জাহান্নামিদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে তাকে জাহান্নামে তার স্থান দেখানো হয়।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩৭৯)
এ হাদিস প্রমাণ করে, মৃত্যুর পর থেকেই আত্মার চূড়ান্ত পরিণতি নির্ধারণ হতে শুরু করে। কেউ জান্নাতের সুখে, কেউ জাহান্নামের ভয়াবহতায় অবস্থান করে—যতক্ষণ না কিয়ামত সংঘটিত হয়।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, বদরের যুদ্ধে নিহত কাফেরদের সম্বোধন করে রাসুল (সা.) বলেন,
“হে আবু জাহল, হে উতবা, তোমরা কি তোমাদের প্রভুর প্রতিশ্রুতিকে সত্য বলে পেয়েছ? আমি তো আমার প্রভুর প্রতিশ্রুতি সত্য বলে পেয়েছি।”
ওমর (রা.) অবাক হয়ে জানতে চান, “হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি এমন দেহের সঙ্গে কথা বলছেন, যাদের আত্মা নেই?”
রাসুল (সা.) বলেন, “যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা যা বলছি তা শোনার ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি শ্রবণশক্তিসম্পন্ন নও, কিন্তু তারা উত্তর দিতে পারে না।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৭৪)
এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বারজাখের জীবন বাস্তব এবং আত্মা কোনো না কোনোভাবে সচেতন থাকে। তবে এর পূর্ণ রূপ কেবল আল্লাহ ও মৃত ব্যক্তিরাই জানেন।
বারজাখের জীবন দুনিয়া ও পরকালের সংযোগস্থল, যেখানে আত্মা তার পরিণতির প্রাথমিক অভিজ্ঞতা লাভ করে। তাই মানুষের উচিত দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী আনন্দে বিভোর না হয়ে মৃত্যুর পরের জীবনের প্রস্তুতি নেওয়া—আল্লাহর আদেশ মেনে চলা, সৎকর্মে নিয়োজিত থাকা এবং পাপ থেকে দূরে থাকা।
আলোকিত গৌড়/আ
মন্তব্য করুন: