মানবসভ্যতার ইতিহাসে যুদ্ধ যেন এক অনিবার্য বাস্তবতা। আধুনিক পৃথিবী শান্তির কথা বললেও গাজা, কাশ্মীর, সিরিয়া কিংবা ইউক্রেনে এখনো বইছে রক্তের নদী।
মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো বড় শক্তিগুলো শান্তির বার্তা দিলেও বাস্তবে তাদের দ্বিচারিতা পৃথিবীকে করে তুলছে আরও অশান্ত। এই পরিস্থিতিতে ইসলামী মানবাধিকারনীতিই একমাত্র ন্যায়নিষ্ঠ পথ, যা মানবতার জন্য স্থায়ী সমাধানের দিগন্ত উন্মোচন করে—যেখানে যুদ্ধও সীমার মধ্যে পরিচালিত হয়, আর শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যায়ের ভিত্তিতে।
ইসলামে মানবাধিকার কোনো মানুষের বানানো ধারণা নয়, বরং মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিধান। কোরআনে বলা হয়েছে— “হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা নিসা : ১)।
এ আয়াতে মানবসমতার মূল শিক্ষা নিহিত আছে। জাত, বর্ণ বা অবস্থান নির্বিশেষে সব মানুষই সম্মানিত। পবিত্র কোরআন আরও ঘোষণা করে— “আমরা অবশ্যই আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি…” (সুরা বনি ইসরাঈল : ৭০)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, “তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও ইজ্জত তোমাদের জন্য হারাম।” (বুখারি, হাদিস : ১৭৩৯)। এটি ইতিহাসের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মানবাধিকার ঘোষণাপত্র হিসেবে বিবেচিত।
ইসলামী রাষ্ট্রে শুধু মুসলমান নয়, অমুসলিম নাগরিকও সমানভাবে নিরাপদ। মহানবী (সা.) সতর্ক করে বলেন— “যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর জুলুম করবে, আমি কিয়ামতের দিন তার বিপক্ষে বাদী হব।” (আবু দাউদ : ৩০৫২)।
ইসলামী শাসনে অমুসলিমদের উপাসনালয়, সম্পদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করা হতো। নারী, শ্রমিক, শিক্ষা ও ন্যায্যবিচার—সবই ছিল ইসলামী মানবাধিকার কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত।
ইসলাম যুদ্ধকে আগ্রাসনের হাতিয়ার হিসেবে নয়, আত্মরক্ষা ও ন্যায়ের পুনঃপ্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে দেখে। কোরআনে বলা হয়েছে— “যে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো; কিন্তু সীমা লঙ্ঘন কোরো না।” (সুরা আল-বাকারাহ : ১৯০)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধের আগে নির্দেশ দিতেন— “নারী, শিশু, বৃদ্ধকে হত্যা কোরো না; ফলবান গাছ কেটো না; উপাসনালয়ের ধর্মযাজকদের ক্ষতি কোরো না।” (মুয়াত্তা মালিক : ৯৭২)।
বন্দিদের প্রতিও ইসলাম দেখিয়েছে অসাধারণ মানবিকতা—“তারা খাদ্য দেয় নিজেদের ভালোবাসার কারণে দরিদ্র, এতিম ও বন্দিদের।” (সুরা আদ-দাহর : ৮)। বদরযুদ্ধের বন্দিদের কেউ শিক্ষা দিয়ে, কেউ নিঃস্বার্থভাবে মুক্তি পেয়েছিলেন—যা আজকের জেনেভা কনভেনশনের নীতির ভিত্তি হয়ে আছে।
কোরআনের নির্দেশ— “যদি তারা শান্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে তুমিও শান্তির দিকে ঝুঁকে পোড়ো।” (সুরা আনফাল : ৬১)। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ শান্তি চাইলে মুসলমানের কর্তব্য হলো অস্ত্র নামিয়ে শান্তির পথ বেছে নেওয়া।
জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে জীবনের অধিকার, মত প্রকাশ, ধর্ম ও ন্যায়ের কথা বলা হয়েছে—যা ইসলাম ১৪০০ বছর আগে আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করেছে। আধুনিক দর্শন স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে, আর ইসলাম কেন্দ্র করে দায়িত্বকে—যেখানে সীমাহীন স্বাধীনতার পরিবর্তে নৈতিক সীমা সমাজে আনে স্থিতি ও ন্যায়।
আজ মানবাধিকার রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে গেছে। গাজায় শিশু হত্যার পরও বিশ্ব নীরব, অথচ মহানবী (সা.) যুদ্ধক্ষেত্রে একটি শিশুর মৃতদেহ দেখে কেঁদে উঠেছিলেন—এটাই মানবিকতার প্রকৃত রূপ।
খলিফা উমর (রা.) জেরুজালেম বিজয়ের পর গির্জায় নামাজ না পড়ে তা সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন—যেন ভবিষ্যতে মুসলমানরা দখল না নেয়। এটি ইতিহাসের এক অনন্য মানবাধিকার দলিল।
ইসলাম শুধু শান্তির ধর্ম নয়, বরং ন্যায় ও মানবতার ধর্ম। যুদ্ধের সময় যেমন মানবতার মর্যাদা রক্ষা করেছে, শান্তির সময় তেমনি তা পূর্ণতা দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— “প্রকৃত শক্তিশালী সে নয়, যে যুদ্ধে জয়ী হয়; বরং সে, যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।” (বুখারি : ৬১১৪)।
আজকের বিশ্বে ইসলামী মানবাধিকারনীতি শুধুই অতীতের ইতিহাস নয়—এটি ভবিষ্যতের ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবিক সভ্যতার ভিত্তি।
আলোকিত গৌড়/আ
মন্তব্য করুন: