[email protected] শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫
৪ পৌষ ১৪৩২

ওয়াজ ও দাওয়াতে শব্দ-সংযম জরুরি: ইসলামের শিক্ষা

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৫১

ফাইল ছবি

ইসলাম কেবল কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদতের নাম নয়; বরং এটি শান্তি, ভারসাম্য ও মানবিকতায় সমৃদ্ধ একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই দ্বিন যেমন ইবাদত-বন্দেগির গুরুত্ব দেয়, তেমনি মানুষের আরাম, অধিকার, মর্যাদা ও মানসিক স্বস্তিকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেয়। ইসলামের প্রতিটি বিধানে বান্দার হক সংরক্ষণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে ওয়াজ-নসিহত ও দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের অন্তরে ঈমানের আলো জ্বালানো, তাদের চরিত্রকে পরিশীলিত করা এবং আল্লাহমুখী করে তোলা। দাওয়াত কখনোই মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি, বিরক্তি কিংবা কষ্টের কারণ হতে পারে না। বরং তা হতে হবে কোমল, শালীন ও প্রজ্ঞাপূর্ণ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,

‘হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো’ (সুরা নাহল: ১২৫)।

এই নির্দেশনা অনুযায়ী দাওয়াতের পদ্ধতিও ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের অংশ। তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বর্তমানে অনেক জায়গায় ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মীয় সমাবেশে মাইক ও লাউডস্পিকারের অতিরিক্ত ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় অত্যন্ত উচ্চ শব্দে বয়ান প্রচার করা হয়, যা আশপাশের মানুষের জন্য বিরক্তি ও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে একজন অসুস্থ মানুষ, বৃদ্ধ, পরীক্ষার্থী, ঘুমন্ত শিশু কিংবা বিশ্রামরত ব্যক্তিরও অধিকার রয়েছে। তাদের এই স্বাভাবিক অধিকার লঙ্ঘন করে যদি দাওয়াত দেওয়া হয়, তাহলে তা ইসলামের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। কারণ ইসলাম কখনোই মানুষের কষ্টের বিনিময়ে ইবাদতকে গ্রহণযোগ্য মনে করে না।

ওয়াজ মাহফিল নিঃসন্দেহে দ্বিন প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তবে এটি তখনই কল্যাণকর হয়, যখন শালীনতা, সংযম ও প্রজ্ঞার সঙ্গে দাওয়াত দেওয়া হয়। প্রযুক্তি আল্লাহর এক নিয়ামত হলেও, সীমা অতিক্রম করলে তা মানুষের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী, মাইক বা লাউডস্পিকার কোনো ইবাদত নয়; বরং একটি সহায়ক উপকরণ মাত্র। শরিয়তে কোথাও ওয়াজ, খুতবা বা বয়ানের জন্য মাইক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়নি। আজানের ক্ষেত্রে দূর পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছানো প্রয়োজনীয় হলেও, ওয়াজ-নসিহত বা কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ পাড়া-মহল্লাজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

ফিকহের গ্রন্থগুলোতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত উচ্চ আওয়াজ ইসলামের দৃষ্টিতে ত্রুটি হিসেবে বিবেচিত। সাহাবায়ে কেরামের যুগেও শব্দ-সংযমের ওপর কঠোর গুরুত্ব দেওয়া হতো। ইতিহাসে দেখা যায়, উচ্চ আওয়াজে ওয়াজ করে অন্যের ইবাদতে বিঘ্ন ঘটালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে অনেক এলাকায় গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ মাহফিলে উচ্চ শব্দে মাইক ব্যবহার করা হয়, যা আশপাশের মানুষের ঘুম, বিশ্রাম ও স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত করে। এতে শিক্ষার্থী, রোগী, বৃদ্ধ ও শিশুদের পাশাপাশি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও কষ্ট পান। অথচ ইসলাম কাউকে কষ্ট দিয়ে দাওয়াত দেওয়ার অনুমতি দেয় না।

এ বিষয়ে হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, উচ্চ আওয়াজে কিরআত বা ইবাদতের মাধ্যমে একে অন্যকে কষ্ট না দিতে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, ইবাদত হলেও তা অন্যের জন্য কষ্টের কারণ হলে গ্রহণযোগ্য নয়।

আলেমদের মতে, মাইক ও শব্দযন্ত্রের ব্যবহার হতে হবে কেবল প্রয়োজনের সীমার মধ্যে। যেখানে ভেতরের ব্যবস্থাতেই কাজ চলে, সেখানে বাইরের লাউডস্পিকার ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত। বিশেষ করে বৃদ্ধ, অসুস্থ, নারী ও শিশুদের অবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াই ইসলামী শিষ্টাচারের অংশ।

ইসলামের দাওয়াতের প্রকৃত রূপ হলোহিকমত, শালীনতা ও রহমতের সঙ্গে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া। কণ্ঠের উচ্চতা নয়, বরং বক্তব্যের গভীরতা ও আন্তরিকতাই মানুষের হৃদয় জয় করেএটাই ইসলামের শিক্ষা।

আলোকিত গৌড়/আ

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর